কিভাবে কন্ট্রোল করবেন রক্তচাপ
প্রেসার মাপার যন্ত্র হাতে বসে থাকা ডাক্তার আর তার সামনে দুরু দুরু বুক নিয়ে বসে আছেন আপনি। আপনার কপালে হয়তোবা সুক্ষ্ন রেখার মত কিছুটা ঘাম। সামনে বসা ব্যাক্তিটি নিবিড় মনোযোগের সাথে তার যন্ত্রটির প্রেসার নির্ণায়ক কাটাটির দিকে লক্ষ্য রাখছেন। সেই সাথে চেষ্টা করছেন তার স্টেথিসকোপে কিছু শোনার। এক সময় তার কাজ শেষ হলো। সাথে সাথেই আপনার প্রশ্ন, ডাক্তার সাহেব প্রেসারের অবস্থা কি? আগের মতোই নাকি কিছুটা বেড়েছে? গম্ভীর মুখে তিনি জবাব দিলেন, না তেমন কিছুনা। সামান্য বেশি (*১)। ব্যাস। শুরু হলো আপনার টেনশন। বাড়ছে প্রেসার। মানে হৃদপিন্ড থেকে সারা শরীরের দূর থেকে দূরতর প্রান্তে সরু সরু নালীকার ভেতরে দিয়ে রক্ত কণিকাগুলো অস্থির ছোটাছুটি।
ডাক্তার যতই বলুক সমস্যা নেই, আমি ঔষুধ দিয়ে দিচ্ছি অথবা একদম টেনশন করবেন না, রেষ্ট নেবেন- আপনি কি শুনবেন? লাভ নাই, লাভ নাই ছোট সে তরী- আমারি টেনশনে গিয়াছে ভরি। না চাইলেও হাজারটা চিন্তা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত আপনার মাথায় এসে ল্যান্ড করবে। কেন প্রেসারটা বাড়লো? ঔষুধ কি কাজ করছেনা? খাবারে কি কোন সমস্যা হলো, ইত্যাদি ইত্যাদি। আপনি তখন স্বাভাবিকভাবেই চাইবেন আপনার আগের ব্যবহার করা ঔষুধগুলো পাল্টাতে অথবা ঔষুধের মাত্রা পরিবর্তন করতে। আচ্ছা, হাই ব্লাড প্রেসার কন্ট্রোলে ঔষুধের বিকল্প কিছু কি ভাবা যায়? এমন কিছু যা ঔষুধের চাইতেও বেশি কার্যকর?
সম্ভব কিন্তু কাজটা খুব সহজ নয়। কারণ ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রনে যে ঔষুধগুলো বাজারে আছে, তাদের বিজ্ঞাপন এতোটাই চটকদার যে বেশিরভাগ সময় ডাক্তাররা সাত-পাঁচ না ভেবেই রোগীদের এসব ঔষুধ সাজেস্ট করেন। আসলে ভাবার বিষয় হলো, সত্যি সত্যি এই ঔষুধগুলো উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে কতটা কার্যকরী? ২০০৩ এর জুলাইতে ‘ জার্নাল অব দ্যা আমেরিকান মেডিকেল এ্যসোসেয়েশন’ এর প্রকাশিক এক প্রবন্ধে বলা হয়, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক পূর্ন বয়স্ক লোকের উপর জরিপ চালান যারা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন । তারা দেখতে পান যে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে বাজারে প্রচলিত ঔষুধগুলোর আসলে কোন ভূমিকাই নেই। তাহলে উপায়? ধীরে, চিন্তা করে প্রেসার বাড়ানোর দরকার নেই। আমরা বিকল্প কিছু ভাববো। তার আগে চলুন জেনে নেই উচ্চ রক্তচাপ কি এবং কেন হয়।
রক্ত চাপ হলো এক কথায় রক্তের চাপ। রক্ত যখন হৃদপিন্ডের সংকোচন-প্রসারণের ফলে ধমনীর মধ্য দিয়ে শরীরে প্রবাহিত হয়, তখন এই প্রবাহিত রক্ত ধমনীর অভ্যন্তরীন দেয়ালে চাপের সৃষ্টি করে। এই চাপই হলো রক্তচাপ। যখন এই চাপের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয় তখন এটাকে বলি উচ্চ রক্তচাপ। আমরা যখন বিশ্রামে থাকি এবং ধরে নেওয়া যায় শরীরের কল-কব্জাগুলো ঠিকমতোই কাজ করছে, তখন আমাদের শরীরের স্বাভাবিক রক্তচাপ সাধারণত 120/80 mmHg এর কম। আবার বয়সভেদে এর তারতম্যও হতে পারে। কিন্তু যখন ক্রমাগত কয়েক সপ্তাহের রক্তচাপের পরিমাপ 140/90 mmHg এর বেশি হবে তখন এটাকে উচ্চ রক্তচাপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমনিতে সারাদিনের কাজ-কর্মে রক্তচাপ কখনো বেশি হয়, আবার কখনো কম হয়। বয়সের কারণেও রক্তচাপের তারতম্য হতে পারে। আবার কিছু কিছু রোগী আছেন যখনি তারা ডাক্তারের চেম্বারে যান, তখনি তাদের রক্তচাপ বেড়ে যায়। তখন ডাক্তার হয় ঐ রোগীর বাসায় রক্তচাপ নির্নয়ের ব্যবস্থা করেন অথবা একটি বিশেষ রক্তচাপ নির্নায়ক যন্ত্র ব্যবহার করেন। এই যন্ত্র রোগীর শরীরে সারাদিন লাগানো থাকে এবং সে স্বয়ক্রিয়ভাবে প্রতি ৩০ মিনিট অন্তর রোগীর রক্তচাপ নির্ণয় করে। আসলে হঠাৎ করে একবার ব্লাড প্রেসার বেশি হলে সেটাকে উচ্চ রক্তচাপ হিসেবে চিহ্নিত করার কিছু নেই। আর এই উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে খুব চিন্তার প্রয়োজন নেই যতক্ষন না এটি একাধারে বেশ অনেকদিন থাকে। যদি কখনো এমনটা হয় তবে আপনাকে অবশ্যই যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। নয়তো দেখা যাবে বলা নেই, কওনা নেই হার্টখানা হঠাৎ করে কাজ-কারবার বন্ধ করে দিয়েছে। ফলাফল হার্ট এ্যটার্ক। পরিণতিতে মৃত্যুও হতে পারে। সুতরাং, এই উচ্চ রক্তচাপকে একদম অবহেলা করা যাবে না।
বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় ১০০ কোটি লোক এই রোগে আক্রান্ত। উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগ এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের জন্য বহুলাংশে দায়ী; যা মৃত্যুর কারণ পর্যন্ত হতে পারে।
প্রাণরাসায়নিক ভিত্তিতে এই কারণগুলো আলোচনা করা যাক। উচ্চ রক্তচাপের জন্য প্রথমেই আমরা দায়ী করবো আমাদের রক্তে উপস্থিত ইনসুলিনের (*৩) মাত্রাকে। যখন আপনি বেশি পরিমাণ দানাদার খাবার গ্রহন করবেন অথবা অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবারে অভ্যস্থ হবেন অথচ পর্যাপ্ত পরিমান ব্যায়াম করবেন না, তখনি আপনার রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা বেড়ে যাবে। উচ্চ রক্তচাপ রক্তে বেশি মাত্রায় উপস্থিত এই ইনসুলিনের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। অথবা যাদের ইনসুলিন রেজিস্টেন্সি (*৪) আছে তাদের জন্যও রক্তে উপস্থিত ইনসুলিন উচ্চ রক্তচাপের জন্য দায়ী। এই সকল ক্ষেত্রে যখনি রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা বাড়বে, তখনি আপনার রক্তচাপও বাড়বে। একবারে গুনাগুপাতিক পদ্ধতিতে। সুতরাং, আপনার উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনের প্রথম ধাপ হলো, রক্তে ইনসুলিনের মাত্রাকে স্বাভাবিক রাখা।
সাধারণত যারা মোটা তারা স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন। এই সকল উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীদের অবশ্যই মিষ্টি জাতীয় খাবার ও দানাদার খাবার এড়িয়ে চলা উচিত, অনন্ত যতক্ষন না তাদের রক্তচাপ স্বাভাবিক হচ্ছে। আর রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখার জন্য এটি একটি কার্যকর পদক্ষেপ। আমাদের শরীরে যে ইনসুলিন আছে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সে শরীরের ম্যাগনেসিয়ামগুলোকে ধরে রাখে বা সঞ্চয় করে রাখে। এই ম্যাগনেসিয়াম আমাদের শরীরে অনেক গুরুত্বপূর্ন কাজ করে। এর মধ্যে অন্যতম হলো এরা আমাদের মাংশপেশীর কোষগুলোকে, রক্তনালীকে রিলাক্স অবস্থায় রাখে। কিন্তু যখন আমাদের কোষের মধ্যে যে ইনসুলিন রিসেপ্টরগুলো আছে, তারা ভোতা হয়, মানে ইনসুলিনগুলোকে ধরতে পারেনা, তখন ইনসুলিন আর কোষের অভ্যন্তর প্রবেশ করতে পারে না। এটা আমাদের শরীরের একটা গুরুত্বপূর্ন প্রক্রিয়া। কারণ ইনসুলিনকে তার কাজ করতে হলে অবশ্যই কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে হবে এবং সে এটা নিজে নিজে করতে পারে না। কোষের ভেতরে থাকে ইনসুলিন রিসেপ্টর। সে এই ইনসুলিনকে কোষের ভেতরে নিয়ে যায় এবং কেবল তখনি ইনসুলিন তার কাজ করতে পারে। কিন্তু রিসেপ্টরে কোন সমস্যা হলে এই কাজটা আর তখন হয় না। তখন এই কোষগুলোকে বলা হয় ইনসুলিন রেজিস্টেন্স। মানে তারা রক্তে উপস্থিত ইনসুলিন ব্যবহারে অসামর্থ্য। এই অবস্থায় ইনসুলিন আর শরীরের ম্যাগনেসিয়ামগুলোকে ধরে রাখতে পারে না। এই ম্যাগনেসিয়ামগুলো তখন ইউরিনের সাথে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। ফলে শরীরে ম্যগনেসিয়ামের মাত্রা কমে যায়। আগেই বলেছি ম্যাগনেসিয়াম শরীরের মাংশপেশীকে, রক্তবাহী নালীকে রিলাক্স অবস্থায় বা প্রসারিত রাখে। সুতরাং, যখনি শরীরে ম্যাগনেসিয়ামের মাত্রা কমে যাবে তখনি রক্তবাহী নালীগুলো প্রসারনের বদলে সঙ্কুচিত হবে এবং এতে করে রক্তচাপ বেড়ে যাবে।
রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও ইনসুলিনের ভূমিকা রয়েছে। সহজভাবে বলতে গেলে, রক্তে যতবেশি ইনসুলিন থাকবে ততবেশি সোডিয়ামও থাকবে। রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা বাড়লে তরল পর্দাথের মাত্রাও বাড়বে এবং এই তরল পর্দাথ রক্তচাপ বৃদ্ধির সাথে জড়িত।
তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো? আপনাকে উচ্চ-শর্করা যুক্ত খাবার ছাড়তে হবে। কারণ এই খাবার আপনার শরীরে স্যুগারের মাত্রা বাড়াবে যার ফলে বেড়ে যাবে ইনসুলিনের মাত্রা। এই অতিরিক্ত ইনসুলিন শুধুমাত্র উচ্চ রক্তচাপের জন্যই দায়ী নয়, এটি আপনার সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমের উত্তেজক হিসেবেও ভূমিকা রাখে। যা একজন উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্ত রোগীর জন্য কোন ভাবেই কাম্য নয়।
আপনি নিশ্চই ভোজন রসিক? আর যদি আপনার শরীরের ওজনটা হয় বেশি তাহলে আপনাকে একটা দু:সংবাদ দিচ্ছি। আপনাকে আপনার খাদ্যাভাস অবশ্যই এবং অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে সেই সাথে কমাতে হবে শরীরের বাড়তি ওজন (*৫)। কারণটা খুব সহজ। আপনি কি আপনার উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রন করতে ও দীর্ঘায়ূ পেতে চান না? তাহলে এই কাজের কোন বিকল্প নেই। আসলে খাবার হলো আমাদের দেহের জ্বালানী। সব গাড়ি যেমন এক জ্বালীনিতে চলে না, তেমনি সবার জন্য একই ধরণের খাবার প্রযোজ্য নয়। এজন্য দেখা যায় কেউ উচ্চ প্রোটিন-স্বল্প শর্করা যুক্ত খাবার খেয়ে সুস্থ আছে, আবার অন্য কেউ একই খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। এজন্য আমাদের অবশ্যই জানা উচিত ঠিক কি ধরণের খাবার আমাদের জন্য উপযোগী। শরীর সুস্থ রাখার জন্য খাদ্যমান জানা এবং সে অনুযায়ী খাদ্য গ্রহন আমাদের দেহের নির্মল সুস্থতার জন্যই প্রয়োজন। দেহের প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্য গ্রহনই হলো উত্তম পন্থা। গবেষণায় দেখা যায় প্রক্রিয়াজাত খাদ্য বিশেষ করে পূর্বে প্রস্তুত করা ফ্রোজেন ডিনার, চিপস, সোডা, ফ্রাইড চিকেন, কুকিস, ক্রেকারস এবং ফাস্ট ফুড সরাসরি উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধির সাথে জড়িত এবং সেই সাথে দায়ী ডায়াবেটিকস এর জন্যও। এই সকল জাঙ্ক ফুড যে উচ্চ মাত্রার স্যুগার, অস্বাস্থ্যকর চর্বি এবং ফ্রুক্টোজ বহন করে সেগুলো কেবল আপনাকে অসুস্থই করবে না, বাড়াবে আপনার দেহের ওজনও।
মানসিক চাপের সাথে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্ক অনেক পরিচিত একটা ব্যাপার। সাধারণত দেখা যায় যে হৃদরোগের রোগীরা তাদের রোগের প্রায় ৭০% নিরাময় করতে পারে শুধু যদি তারা জানে কি ভাবে এই মানসিক চাপ বা স্ট্রেসকে নিয়ন্ত্রন করা যায়। মানসিক নিপীড়ন যেমন ভয়, রাগ, দু:খবোধকে নিয়ন্ত্রনে রাখা আমাদের মানসিক চাপহীন প্রতিদিনের জীবনের জন্য খুবই প্রয়োজন।
রোদ দেখলে চোখ কুচকে ফেলেন? কালো হবার ভয়ে রোদে যেতে না চাইলে আরেকটি খারাপ খবর আছে আপনার জন্য। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, ভাইটামিন-ডি শরীরের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমরা যখন সূর্যের আলো বা রোদে যাই তখন দেহে এই ভাইটামিন-ডি উৎপন্ন হয়। কিন্তু যদি না যাই? মানে আমরা যদি সূর্যের আলো থেকে নিজেদের সবসময় আড়াল করে রাখি? তখন দেহে এই ভাইটামিনটি কম উৎপন্ন হবে আর তার বদলে হরমোন গ্রন্থি থেকে বেশি পরিমাণে প্যারাথাইরয়েড হরমোন (*৬) উৎপন্ন হবে। এই হরমোন উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধির জন্য দায়ী। সুতরাং প্রতিদিন কিছুটা সময় সূর্যের আলো পোহানো উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে যথেষ্ট কার্যকর।
বিশেষজ্ঞগণ উচ্চরক্তচাপের জন্য বেশ কিছু কারণ নির্ণয় করেছেন। যেমন- অতিরিক্ত শারীরিক ওজন, খাদ্যে অধিক মাত্রায় সোডিয়ামের উপস্থিতি, অল্প পরিমাণে শারীরিক কাজ-কর্ম করা, কম পরিমাণে ফল, শাক-সবজি খাওয়া এবং খাদ্যে পটাসিয়ামের উপস্থিতি কম হওয়া। এছাড়া এলকোহলও এর জন্য দায়ী। এখন দেখুনতো, ঔষুধের চাইতে খাদ্যভাস পরিবর্তন এই ক্ষেত্রে কতটা কার্যকর। (*৭)
বাজারে প্রায় ১০০ টিরও অধিক উচ্চ রক্তচাপ নিরোধী ঔষুধ রয়েছে। নিয়মিত ঔষুধ গ্রহনের চাইতে প্রতিদিন কিছুটা সময় শারীরিক এবং মানসিক ব্যায়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে বেশ কার্যকর। এই ব্যায়ামগুলো রোগীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা অনুযায়ী হওয়া দরকার। আপনি চাইলে এই বিকল্প পন্থাগুলো অনুসরণ করতে পারেন যা অনেক অনেক বেশি কার্যকর। তবে একটা কথা গুরুত্বপূর্ণ, বিকল্প পদ্ধতি অনুসরণ করুণ বা ঔষুধ গ্রহন করুন- সবটাই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হওয়া উচিত।
বিশ্বব্যাপী উচ্চ রক্তচাপ এক বিশাল সমস্যা। হৃদরোগ, ডায়াবেটিকস এর সাথেও এই উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কিত। আশা করা যায়, আমরা এই বিকল্পপন্থাগুলো অনুসরণের মাধ্যমে অনেক বেশি কার্যকরভাবে উচ্চ রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারবো। এবং অর্জন করতে পারবো ‘হাইপারটেনশন’ বিহীন নির্মল, সুস্থ দেহ।
পাদটিকা:
*১. রক্তচাপ বা ব্লাড প্রেসার সব সময় বেশি হবে এমন কোন কথা নেই। কম হতে পারে বা স্বাভাবিকও হতে পারে।
*২. Sayeed M A et all, ‘Prevalence of hypertension in Bangladesh: effect of socio-economic risk factor on different between rural and urban community.’
*৩. ইনসুলিন আমাদের দেহের একপ্রকার হরমোন। আরো জানার জন্য গুগলিং করা যেতে পারে।
*৪. টাইপ-২ ডায়াবেটিকস এ আক্রান্ত রোগীদের ইনসুলিন রেজিস্টেন্সি থাকে। এর মানে হলো শরীর ঠিকই ইনসুলিন তৈরী করে কিন্তু কোষগুলো এই ইনসুলিন ব্যবহার করতে পারে না।
*৫. আপনি মোটা হলেই টেনশনের কারণ নাই। আবার বেশি খেলেই মোটা হবেন, বা মোটা হলেই বেশি খাবেন এমন ব্যাপারও নাই। সাধারণত যাদের ওজন বেশি তাদের হাইপারটেনশন হবার ঝুকিটা বেশি থাকে। আপনি চিকন হলেই যে আপনার হাইপারটেনশন হবে না, এমন কথা নেই। তবে, শরীরের বাড়তি ওজন কমানোটা সবদিক দিয়েই উপকারী।
*৬. প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি থেকে এই হরমোন নি:সৃত হয়। হাড়ের গঠনে ভূমিকা রাখে।
*৭. Flegal KM, Carroll MD, Ogden CL, Johnson CL. Prevalence and trends in obesity among US adults, 1999-2000. JAMA 2002;288:1723-7. X.
*রক্তচাপ: পূর্ণ বিশ্রামে থাকা একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের রক্তের চাপ বা ব্লাড প্রেসার হবে ১২০/৮০ মিলি মিটার পারদ চাপ। এক্ষেত্রে ১ম সংখাটি (১২০) দ্বারা হার্ট এর সংকোচনের সময় ধমণীর ব্লাড প্রেসার এবং ২য় সংখাটি দ্বারা হার্ট এর প্রসারণের সময়ে ধমণীর ব্লাড প্রেসার কে নির্দেশ করা হয়। এই ১ম প্রেসার সংখাটি যা সিস্টোলিক প্রেসার নামে ডাকা হয় সবসময়ই ২য় টি থেকে বেশি এবং এর স্বাভাবিক মাত্রা ১৪০ মি.মি এর নীচে এবং ৯০ মি.মি এর উর্ধে । অন্য দিকে ২য় প্রেসার সংখাটি কে ডায়াস্টোলিক প্রেসার ডাকা হয় এবং এর স্বাভাবিক মাত্রা ৯০ মি.মি এর নীচে এবং ৬০ মি.মি এর উর্ধ্বে। তাই যখন উপড়ের প্রেসার টি ১৪০ বা তার উর্ধ্বে অথবা নীচের প্রেসার টি ৯০ বা তার উর্ধ্বে পাওয়া যায় তখন ধরে নিতে হবে রোগীর ব্লাড প্রেসার স্বাভাবিক এর উর্ধ্বে অর্থাৎ তিনি উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন রোগে ভূগছেন। তবে বয়সের উপর ভিত্তি করে এই মাত্রার কিছুটা তারতম্য হতে পারে।
কিভাবে কন্ট্রোল করবেন রক্তচাপ
উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগ এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের জন্য বহুলাংশে দায়ী; যা মৃত্যুর কারণ পর্যন্ত হতে পারে।
রক্তকে পূর্ণাঙ্গভাবে শরীরের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছানোর জন্য হৃৎপিণ্ড প্রতিনিয়ত সংকোচন ও প্রসারণ করে থাকে। সংকোচন ও প্রসারণের সময় রক্তনালির মধ্য দিয়ে রক্ত যাওয়ার সময় শিরার ভেতরে এক প্রকার চাপ প্রয়োগ করে, যাকে আমরা রক্তচাপ বলি। রক্তচাপের কারণেই আমাদের সারা শরীরে রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌঁছাতে পারে। হৃৎপিণ্ড সংকোচনের সময় যে চাপ প্রয়োগ করে তাকে সিস্টোলিক রক্তচাপ বলা হয়; যা সাধারণত ১২০ মিলিমিটার অব মার্কারি হয়ে থাকে। প্রসারণের সময় যে চাপ প্রয়োগ করে তাকে ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ বলে, যা সাধারণত ৮০ মিলিমিটার অব মার্কারি। একটি সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের রক্তচাপ সাধারণত ১২০/৮০ মিলিমিটার অব মার্কারির সঙ্গে ১০ কমবেশি হতে পারে।
যখন একজন মানুষের হৃৎপিণ্ডের সংকোচনের চাপ ১৪০ মিলিমিটার অব মার্কারি থেকে বেশি ও প্রসারণের চাপ ৯০ মিলিমিটার থেকে বেশি হয় এবং তা সর্বনিম্ন টানা সাতদিন একই অবস্থায় থাকে, তখন এই অবস্থাকে উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়।
উচ্চ রক্তচাপ মূলত দুই প্রকার। প্রাথমিক উচ্চ রক্তচাপ বা এসেনশিয়াল হাইপারটেনশন (৯০-৯৫ শতাংশ) এবং গৌণ উচ্চ রক্তচাপ বা সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন (১০-৫ শতাংশ)।
সম্প্রতি কিছু গবেষণায় বলা হয়, আগে দেখা যেত ৪০ বছরের পরের ব্যক্তিরা সাধারণত এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তবে এখন ২০ বা ৩০ বছরের লোকদেরও এই রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। তবে জীবন যাপনের কিছু ধরন মেনে চললে উচ্চ রক্তচাপকে বহুলাংশে কমানো সম্ভব। টাইমস অব ইন্ডিয়া দিয়েছে এই বিষয়ে কিছু পরামর্শ।
স্বাস্থ্যকর ডায়েট
উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে একটি স্বাস্থ্যকর ডায়েট পালন করা খুবই জরুরি। ডায়াটারি অ্যাপ্রোচেস টু স্টপ হাইপারটেনশন (ড্যাশ) বা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ উপায়ে খাদ্যাভ্যাস পালন খুব জরুরি। ড্যাশ ডায়েটে তাজা সবজি, ফল, ননিহীন দুগ্ধজাতীয় খাবার, মাছ, ভূসি বা ভূসি সমেত খাবার, মুরগি এবং বাদাম থাকতে হবে। লাল মাংস, মিষ্টিজাতীয় খাবার এবং মিষ্টি এড়িয়ে যেতে হবে। এই ডায়েটে থাকবে উচ্চ পরিমাণ ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, প্রোটিন এবং আঁশ। চর্বিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
চাপ ব্যবস্থাপনা
গবেষকরা বলেন, মানসিক চাপ এবং উচ্চ রক্তচাপের সরাসরি যোগসূত্র আছে। আধুনিক দিনের বিরক্তিকর জীবন যাপন, লম্বা কাজের সময়, দ্রুত সম্পর্কের ভাঙন- এসবের কারণে এক ধরনের চাপ সব সময় থাকে। বিনোদনের জন্য কোনো অবসরই পাওয়া যায় না। প্রত্যেকেই ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করেন। তাই চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায় শেখা খুব জরুরি। কেননা এটিও বাড়িয়ে দিতে পারে উচ্চ রক্তচাপ। তাই গভীর শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম, নিজেকে সময় দেওয়া, সামাজিক যোগাযোগ বাড়ানো, ইয়োগা এবং মেডিটেশনের মাধ্যমে চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
নিয়মিত ব্যায়াম
অ্যারোবিক ব্যায়াম, নিয়মিত ব্যায়ামের প্রশিক্ষণ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী। যদি কারো প্রি হাইপারটেনশন থাকে (সিস্টোলিক চাপ ১২০ থেকে ১৩৯ মিলিমিটার অব মার্কারি এবং ডায়াস্টোলিক চাপ ৮০ থেকে ৮৯ মিলিমিটার অব মার্কারি) তবে নিয়মিত ব্যায়াম উচ্চরক্তচাপ কমাতে বেশ সাহায্য করে।
লবণ কম গ্রহণ
চর্বিযুক্ত এবং অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার একেবারেই বাদ দিতে হবে। সোডিয়ামের গ্রহণ রক্তচাপকে বাড়িয়ে দেয়। খাবারে বাড়তি লবণ বা কাঁচা লবণ ব্যবহার করা যাবে না। তাই খাবার রান্নার সময়ই যতটুকু লবণ লাগে ব্যবহার করুন।
মদ ও ধূমপান
মদ ও ধূমপানের সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। মদ্যপায়ী এবং চেইন ধূমপায়ীদের এই রোগে বেশি আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। তাই উচ্চ রক্তচাপ কমাতে অবশ্যই এগুলো বাদ দিতে হবে।
উচ্চ রক্তচাপের ফলে হৃদযন্ত্রের কার্যক্রম হ্রাস পাওয়া, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়া, মস্তিষ্কের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়া এধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। একে নীরব ঘাতকও বলা হয়। তাই নিয়মিত রক্তচাপ মাপা খুব জরুরি। এর ফলে আগে থেকেই আপনি বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে সতর্ক থেকে প্রতিরোধ করতে পারবেন।
0 comments: